বায়না দলিল করার পর জমি বিক্রি করতে না চাইলে কি আইনি পদক্ষেপ নেয়া যায় জেনে নিন।

সেলিম সাহেব বিদেশ থেকে এসে রাজিব সরকারের কাছ থেকে একটি জমি ক্রয় করার জন্য একমত হন। দাম নির্ধারণ করার পর সেলিম সাহেব স্থানীয় এক দলিল লেখকের মারফত জমির নির্ধারিত মূল্যের হাফ দিয়ে বায়না দলিল করেন।

উক্ত বায়না দলিলে উল্লেখ ছিল আগামী ছয় মাসের মধ্যে সেলিম সাহেব বাকি টাকা পরিশোধ করার সাথে সাথেই রাজিব সরকার উক্ত জমি সাফ কবলা দলিল করে সেলিম সাহেবকে সম্পুর্ন মালিকানা হস্তান্তর করবেন।

কিন্তু, রাজিব সরকারের কাহিনী ভিন্ন। রাজিব সরকার মূলত সাময়িক অসুবিধায় পড়ে তার ঐ জমি বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। সেলিম সাহেব যখন বায়না বাবদ হাফ টাকা পরিশোধ করেন, সেই টাকা দিয়েই রাজিব সরকার তার সাময়িক অসুবিধা দূর করেন। বিপদ কেটে গেলে মানুষ নাকি উপকার ভুলে যায়, রাজিব সরকারও পাল্টে গেলেন। তিনি এখন এই কম দামে জমি বিক্রি করতে চান না। তিনি অসুবিধায় পড়েছিলেন বলে, তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সেলিম সাহেব কম দামে জমির বায়না দলিল করিয়ে নিয়েছেন, অথচ এই জমির প্রকৃত মূল্য আরও অনেক বেশি হবে ইত্যাদি অজুহাতে রাজিব সরকার সাহেব জমি বিক্রি করতে আর আগ্রহী নন।

এই দিকে সেলিম সাহেব তার নিজের কাছে সঞ্চিত টাকা দিয়ে বায়না করেছেন, বাকি টাকা তিনি ঋণ নিয়ে পরিশোধ করার যে পরিকল্পনা ছিল, সেই অনুসারে তিনি বেশ খানিক দূর এগিয়ে গেছেন। এখন রাজিব সরকার সাহেব যে কোন মতেই জমি বিক্রি বা সাফ কবলা দলিল রেজিস্ট্রেশন করে দিতে রাজি হচ্ছেন না। সেলিম সাহেব এলাকার মাতুব্বর দের নিয়ে সালিশের দ্বারস্থ হলেন, দলিল লেখক নিজে মধ্যস্থতা করলেন, তবুও রাজিব সরকার মোটেও জমি বিক্রি করতে সম্মান নন। তিনি সেলিম সাহেবের কাছ থেকে নেওয়া টাকা ফেরত দিয়ে দিতে চান, তবে সকলেই জানে তিনি চাইলেও একবারে উক্ত টাকা পরিশোধ করতে পারবেন না। তাই, সকলের দাবী হচ্ছে জমিটির বিক্রি ও হস্তান্তর সম্পন্ন করা হোক, কেননা রাজিব সরকারের উদ্দেশ্য ভালো নয় বলে সকলেই অবগত।

এক্ষেত্রে, সেলিম সাহেব কি করতে পারেন?

সেলিম সাহেব বা যারা বায়না দলিল এবং বায়না টাকা পরিশোধ করার পরও দলিল রেজিস্ট্রেশন করে পায় না অথবা বিক্রেতা জমির দলিল রেজিস্ট্রেশন করে দিতে না চাইলে যে যে আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারেন, তা নিচে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হল।

পদক্ষেপ ১- সেলিম সাহেব তথা বায়না দলিল সূত্রে গ্রহীতা যদি ইচ্ছে করেন তাহলে রাজিব সরকার তথা বায়না দলিল সূত্রে দাতাকে কিছু সময় দিতে পারেন যেন বায়না মূলে দেওয়া টাকা পরিশোধ করতে পারেন। অনেক সময় এটি করেই অধিক ঝামেলা মুক্ত উপায়ে এধরনের বিরোধ নিষ্পত্তি করা সম্ভব।

পদক্ষেপ ২- সেলিম সাহেব তথা বায়না দলিল সূত্রে গ্রহীতা রাজিব সরকার তথা বায়না দলিল সূত্রে দাতার বিরুদ্ধে চুক্তির সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন করার জন্য দেওয়ানি আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন। চুক্তির সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়নের উদ্দেশে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন রয়েছে। সেলিম সাহেব যেহেতু বায়না চুক্তি করেছেন এবং রাজিব সরকার সাহেব সজ্ঞানে সুস্থ মস্তিষ্কে দস্তখত করে বায়নার টাকাও গ্রহণ করেছেন, সেহেতু রাজিব সরকার সাহেব যুক্তি সঙ্গত কারণ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হলে উক্ত চুক্তির সুনির্দিষ্ট সম্পাদন করতে তাকে বাধ্য করা যাবে। সেক্ষেত্রে মাননীয় আদালত যদি চুক্তি সুনির্দিষ্ট সম্পাদনের প্রয়োজনীয়তা মনে করেন, তবে উক্ত জমি বিক্রয় চুক্তি সম্পাদন করার আদেশ দিবেন।

এতে সেলিম সাহেব তথা বায়না দলিল সূত্রে গ্রহীতা বাকি টাকা পরিশোধ করে রাজিব সরকার তথা বায়না দলিল সূত্রে বিক্রেতার কাছ থেকে দলিল রেজিস্ট্রেশন করে নিতে পারবেন। মাননীয় আদালত যদি বাকি টাকা আদালতে জমা দেওয়ার আদেশ দেন, তাহলে আদালতেই বাকি টাকা জমা দিতে হবে।

পদক্ষেপ ৩– সেলিম সাহেব তথা বায়না দলিল সূত্রে ক্রেতা বা গ্রহীতা রাজিব সরকার তথা বায়না দলিল সূত্রে বিক্রেতার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারবেন।

তবে, ক্ষতিপূরণের আবেদন করে ক্ষতিপূরণ পেয়ে গেলে বা না পেলে , পরবর্তীতে চুক্তির সুনির্দিষ্ট সম্পাদনের জন্য মোকদ্দমা করা যাবে না।

ক্ষতিপূরণের মোকদ্দমা চুক্তির সুনির্দিষ্ট সম্পাদনের মোকদ্দমার সাথেই দায়ের করতে হবে। অন্যথায়, মোকদ্দমাটি আইনের দ্বারাই বারিত হবে।

বায়না দলিল নিয়ে কিছু সচরাচর করা প্রশ্ন উত্তর

সব দলিলের ক্ষেত্রেই কি বায়না করা প্রয়োজন?

না। শুধুমাত্র সাফ কবলা দলিল করার পূর্বেই বায়না দলিল করা হয়ে থাকে। দান অথবা হেবা দলিল করতে বায়না দলিল প্রয়োজন হয় না।

বায়না দলিলে যদি সময় উল্লেখ না থাকে?

বায়না দলিল সম্পাদনের কত দিনের মধ্যে মূল দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, তা যদি বায়না দলিলে উল্লেখ না থাকে, তবে বায়না দলিল সম্পাদনের তারিখ থেকে পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে সাফ কবলা দলিল সম্পাদন করতে হবে।

বায়না করার পর বায়না দলিল মূলে ক্রেতা কি কি সুবিধা পেতে পারেন?

বায়না দলিল করার পর বায়না দলিল মূলে গ্রহীতা/ক্রেতা জমিতে নিজের নামে সাইনবোর্ড লাগাতে পারবেন। সাইনবোর্ডে তিনি উল্লেখ করতে পারবেন যে, তিনি উক্ত জমি ক্রয়ের জন্য বায়না দলিল সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া, তিনি উক্ত জমিতে যদি বিল্ডিং বা অন্য কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মান করতে চান, তাহলে সেই অনুযায়ী কতৃপক্ষের অনুমতি বা ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য আবেদন করতে পড়বেন।

উল্লেখ্য, বায়না দলিল থেকে বায়নাকারী যত ধরনের আইনি সুযোগ সুবিধা নিতে চান, তার পূর্ব শর্ত হচ্ছে উক্ত বায়না দলিলটি অবশ্যই সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন করে নিতে হবে। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া বা অনিবন্ধনিত বায়না দলিল দিয়ে কোন আইনি অধিকার দাবী করা যাবে না।