জনকল্যাণ আর শিক্ষা বিস্তারের জনক মাদার বখস একটি নাম একটি ইতিহাস।

জন্ম

১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯০৫  তৎকালীন রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমার সিংড়া থানার  স্থাপনদীঘি নামক গ্রামে এক শিশুর জন্ম হয়। তিনিই যে ভবিষ্যতে দেশসেরা শিক্ষানুরাগী হবেন কেই বা ভেবেছিল?

শিক্ষাজীবন

১৯২২ মাদার বখশ সালে সিংড়ার  চৌগ্রাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় হতে প্রথম শ্রেণীতে ম্যাট্রিক, ১৯২৪ সালে রাজশাহী কলেজ  হতে আই.এ, এবং ১৯২৬ সালে বি.এ ডিগ্রি অর্জন করেন।

তিনি ১৯২৮ সালে কোলকাতা  বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাসে এম.এ, এবং ১৯২৯  সালে কোলকাতা রিপন কলেজ হতে বি.এল ডিগ্রি পান।

কর্মজীবন

বৃহত্তর রাজশাহীর নওগাঁ পোরসার হাই মাদ্রাসায় এবং  মুর্শিদাবাদের সালার উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন তিনি। মাত্র দুই বছরের  শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে তিনি রাজশাহী জজকোর্টে ১৯৩৪ সালে আইন পেশায় যোগদান করেন। আইন পেশায় তিনি প্রভুত জনপ্রিয়তা লাভ করেন। সামর্থ্যহীন বিচারপ্রার্থীদেরকে তিনি  কখনো বিনা পয়সায়, কখনো স্বল্প পয়সায় আইনী সহায়তা দিতেন।

সমাজ সংস্করণ

তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন ‘শিক্ষাই জাতির  মেরুদন্ড’-তাইতো তিনি উত্তরবঙ্গের অবহেলিত-চিরবঞ্চিত পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর  মাঝে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন।

মাদার বখশ এর একান্ত প্রচেষ্টা আর  অধিকার আদায়ে দৃঢ়তার কারণে উত্তরবঙ্গের সর্বস্তরের মানুষের আন্তরিক সহযোগিতায়  রাজশাহীতে ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়। যেটি এখন রাজশাহী  বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ। এই বিশ্ববিদ্যালয়  প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মরহুম মাদার বখশ উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের কৃষক তথা দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পথ উন্মোচন করে দিয়েছেন।

শুধুমাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তিনি রাজশাহীতে আরো কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে  তুলেছেন। রাজশাহী কোর্ট একাডেমি (১৯৫৪ সালে সোবহানিয়া হাই স্কুল নামে  প্রতিষ্ঠিত হয়),  লক্ষ্মীপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, ১৯৬০ সালে, ১৯৪৭ সালে দেশ  বিভাগের পর রাজশাহী মুসলিম হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুল প্রতিষ্ঠায়  তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক  মেডিক্যাল কলেজও স্থাপিত হয় মাদগার বখশ এর অবদানে।

শিক্ষানুরাগী  মাদার বখশ রাজশাহীতে একটি চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রস্তাব  করেছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৪৯ সালে সর্বপ্রথম রাজশাহীতে চিকিৎসা সেবাদানের নিমিত্তে  একটি প্রাইভেট মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মেডিকেল স্কুলটি সরকার ১৯৫৫ সালে গ্রহণ করে। এরপর ১৯৫৮ সালে মেডিকেল স্কুলটি  রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পরিনত হয়।

শিক্ষাবিস্তারের  পাশাপাশি জনাব মাদার বখশ সমাজসেবাতেও অনন্য অবদান রেখে গেছেন। তিনি ১৯৫০ সালের ১৯  সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৪ সালের ২২ জুন পর্যন্ত রাজশাহী পৌরসভার নির্বাচিত  চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর আমলেইল তৎকালীন রাজশাহী পৌর  এলাকায় ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। মাদার বখশ তাঁর সুষম উন্নয়ন কর্মকান্ডের  মধ্য দিয়ে জনগণের বিপুল ভালবাসা অর্জন করেন। তিনিই রাজশাহী নিউ মার্কেটের  রুপকার। মাদার বখশ ১০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে রাজশাহী নিউমার্কেট নির্মাণে   পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে সর্বপ্রথম রাজশাহী শহরে রিক্সা চালু করেন  তিনি। এবং তিনি প্রথম সুইপারদের রেশন প্রদানসহ বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন।  শাহ মখদুম ইন্সটিটিউট, মুসলিম গোরস্থান কমিটি, রিফ্যুজিদের বাসস্থান  ব্যবস্থা, পদ্মার বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে মাদার বখশ  এর অবদান জড়িয়ে আছে।

রাজনৈতিক জীবন

১৯৪৬ সালে তিনি আত্রাই, বাগমারা ও মান্দা থানা  নির্বাচনী এলাকা থেকে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে  পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ আইন  সভার সদস্য ছিলেন। ওই সময়ে সরকার উত্তরাঞ্চলের মানুষের প্রতি চরম বৈষম্য ও  বিমাতাসুলভ আচরন করতে থাকে। এরই প্রতিবাদে মাদার বখশ গর্জে উঠেছিলেন।

১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি ৬ ভূবন মোহন পার্কে আরও একটি জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মাদারবখশ সরকারকে হুশিয়ার করে বলেন, যদি রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না হয় তবে উত্তরবঙ্গকে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ দাবি করতে আমরা বাধ্য হব৷  মাদার বখশের এই বক্তব্যে সাড়া পড়ে দেশের সুধী মহলে৷ টনক নড়ে সরকারেরও৷  অবশেষে ১৯৫৩ সালের মার্চ ৩১ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়  প্রতিষ্ঠা আইন পাশ হয়৷

সততা, নিষ্ঠা, প্রতিভা আর মেধা দিয়ে তৎকালীন  সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দূরবস্থা দূরীকরণের লক্ষ্য নিয়ে তিনি  মুসলিম লীগে যোগদান করেন। অন্যায়-অবিচারের প্রতি সর্বদা সোচ্চার এই মহামানব  বিশিষ্ট রাজনীতিক সমাজসেবক হাজী লাল মোহাম্মদ সরদার এবং আইনবিদ খান  বাহাদুর এমাদউদ্দিন এর মৃত্যুও পরে তাঁদের শূণ্যস্থান পূরণ করতে সক্ষম হন।  নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতা বলে তিনি মুসলিম লীগের একজন অন্যতম নীতিনির্ধারক  হন। এভাবেই রাজনীতিতে তিনি নিজের আসন তৈরী করে নেন।

তৎকালীন মুসলিম  লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা হবার পরও নূরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর  ভাষায় বক্তব্য দিতে কখনও দ্বিধাবোধ করেননি। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার  স্বীকৃতি দেয়া না হলে তিনি আইন পরিষদের সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দেবার  প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন। অসাধারণ নেতৃত্ব, অনুকরণীয় আদর্শ জীবনবোধ, অসীম  সাহস আর মানবতাবাদী এই মানুষটি তাঁর জীবনের পুরোটা সময়জুড়েই তিনি শুধু  সমাজকে দিয়েই গেছেন। বিনিময়ে তিনি কখনও কোন প্রত্যাশা করেননি। নিরলস শ্রম,  সাধনা ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে তিনি জাতীয় জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অসামান্য  অবদান রেখে গেছেন।

তিনি ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী  উচ্চারণ করে বলেন, ‘যদি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া না হয়- তবে  আমি আইন পরিষদের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করবো।’ তিনি আরো বলেন, ‘খুনী নূরুল  আমিন সরকারের আইন পরিষদের একজন সদস্য হিসেবে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে লজ্জায়  আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।’ তখন মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা হয়েও মুসলিম লীগ  সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুরে কথা বলা এবং ঘাতক নূরুল আমিনের প্রতি  ঘৃণা প্রদর্শন করা- কম বড় সাহস ও কৃতিত্বের ব্যাপার নয়। আর এই কারণে মাত্র  কয়েক দিন পর রাজশাহীর সংগ্রামী ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তিনিও কারারুদ্ধ হন।

আমত্মর্জাতিক  খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী এস.এম সুলতান ১৯৮১ সালে ‘মাদার বখশ স্মৃতি পদক’  প্রদান উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় এক শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন, ‘মাদার  বখশের মতো এরকম মহাপুরুষ আরো পাঁচজন হলে দেশের অনেক অভাব পূর্ণ হতো,  শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্র অনেক উপকৃত হতো এবং গুণী, শিল্পী, সাহিত্যিক ও  সমাজসেবীদের মর্যাদা হতো। দেশের শিল্প ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন  কিছু অনুভব করতে পারতাম।’

রাজশাহীর সর্বস্তরের মানুষের কাছে মাদার বখশ একটি পরিচিত নাম। মহৎ ও জনহিতৈষী প্রাণের অধিকারী মাদার বখশ চির জাগরুক হয়ে থাকবেন এই অঞ্চলের মানুষের কাছে। শিক্ষা বিস্তার ও জনকল্যাণের জনক হিসেবে পরিচিত মাদার বখশ এই অঞ্চলের মানুষকে আলোকিত করে গেছেন তাঁর জীবনভর সাধনা আর ত্যাগের মাধ্যমে। এই কীর্তিমান মানুষটি ১৯৬৭ সালের ২০ জানুয়ারি পরলোকগমন করেন। আজ তাঁর ৫৫তম মৃত্যুবার্ষিকী।

এই মহৎপ্রাণ ব্যক্তির  অবদানের ফসল আজকের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত  ক্ষিার্থীদেরও আজ অনেকেই জানেন না মাদার বখশ এর কীর্তি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়  কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ, অন্তত: মাদার বখশ এর মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটিতে  (২০ জানুয়ারি) আপনারা মাদার বখশকে স্মরণ করুন, তাঁর জনকল্যাণ ও শিক্ষা  বিস্তারের কর্মকান্ডসমূহ তুলে ধরুন নতুন প্রজন্মের কাছে।

–  ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত।

Top Lawyer in Bangladesh