মেরি অ্যান বেভান ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত মহিলা। মায়েরা যে সন্তানদের সুখের জন্য সব করতে পারেন, আজ বলবো তেমন একটা ঘটনা। একজন সবচেয়ে সুন্দর মায়ের গল্প। তিনি হলেন মেরি অ্যান বেভান, তিনি “পৃথিবীর সবচেয়ে কুশ্রী মহিলা” হিসাবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু আপনি যখন তার সমন্ধে জানবেন, তখন আপনি তাকে “পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ব্যক্তি” এবং সুন্দরী মা বলে ডাকবেন।”

মেরি অ্যান বেভান জন্মেছিলেন ইংল্যান্ডের নরহ্যামে এক শ্রমজীবী পরিবারে । ১৮৭৪ সাল। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই পূর্ব লন্ডনের শহরতলি প্লেসটোতে বেড়ে উঠেছিলেন মেরি । ওয়েবস্টারদের পরিবারে তখন মেরি অ্যান সহ মোট আট সন্তান। ফলে কম বয়সে জীবন যুদ্ধ শুরু করতে হয়েছিল তাঁকে।

পরিবারের সাথে মেরি অ্যান

তবে জীবনের শুরুতে তিনি মটেই কুৎসিত মুখাবয়ের ছিলেন না। শহরতলির প্রতিবেশীরা বলতেন, ছিপছিপে রোগা মেয়েটির মুখখানি বেশ চোখ টানে। তবে মেরি অ্যানের সে সবের দিকে নজর দেওয়ার সময় ছিল না। তাঁর একটাই স্বপ্ন  আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তার পর একটা বড়সড় সংসার শুরু করবেন। এক পর্যায়ে সে সব স্বপ্নও পূরণ হয় মেরির। অল্প বয়সেই সেবিকার চাকরি পেয়ে যান। ১৯০৩ সালে ২৯ বছর বয়সে টমাস বিভানকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। মেরি অ্যান ওয়েবস্টার।

তবে বিয়ের পর থেকেই নানা অসুখ বাসা বাধতে শুরু করে।  কখনও মাইগ্রেনের সমস্যা। কখনও আবার পেশিতে বা বাতের ব্যথা। তবে সে সবের তোয়াক্কা না করেই সংসার করছিলেন মেরি অ্যান।

স্বামী সন্তানের সাথে মেরি অ্যান

এর মাঝেই চার সন্তানের জননী হয়েছেন তিনি। ফলে সংসারের কাজেই ব্যাস্ত সব সময়।

মাইগ্রেন বা বাতের ব্যথার সঙ্গে এ বার আরও একটি নতুন ও অদ্ভুত সমস্যা শুরু হয়েছিল। মুখের হাড্ডি অস্বাভাবিক ভাবে বড় হতে শুরু করে। এর ফলে ধীরে ধীরে মুখমন্ডল বিকৃত হতে থাকে মেরি অ্যানের। কম বয়সেই তাঁর চেহারা বদলে কুৎসিত হয়ে গিয়েছিল। সংসারের যাতাকলে নুইয়ে পড়া মহিলাদের তো এ রকম ‘ঘরোয়া’ চেহারাই দেখা যায়—অনেকে এমন মন্তব্য করেছিলেন।

কী অসুখ হয়েছে? জানতে চিকিৎসকের কাছে ছুটে যান মেরি অ্যান এবং তার স্বামী টমাস। পরীক্ষা নিরিক্ষার পর চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, মেরি অ্যানের বিরল অসুখের নাম ‘অ্যাক্রোমেগ্যালি’। এটা  এমন এক সমস্যা যাতে দেহে অতিরিক্ত মাত্রায় হরমোন নিঃসৃত হয়। যার ফলস্বরূপ হাড়গোড়, পেশি এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেই সঙ্গে মাথাব্যথা এবং পেশিতে তীব্র যন্ত্রণা হয় । সাধারণত টিউমার থাকায় এই সমস্যা দেখা দেয়। চিৎসকেরা আরও জানিয়েছিলেন, এটাকে পিটুউটারি অ্যাডেনোমাও বলে।

বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞানে এই সমস্যাকে কাটিয়ে উঠা সম্ভব হলেও প্রায় দেড়শো বছর আগে ‘অ্যাক্রোমেগ্যালি’-র সমস্যার তেমন কোন চিকিৎসা ছিল না। ফলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক মুখাবয়ব বিকৃত হতে শুরু করেন মেরি অ্যানের।

এরই মধ্যে সংসারে  হঠাৎই ঘটে ছন্দপতন। বিয়ের মাত্র ১১ বছরের মাথায় মারা যান মেরি অ্যানের হাজবেন্ড টমাস। চার সন্তানকে নিয়ে জীবন সমুদ্রে অথৈ জলে পড়েন তিনি। সংসার চালাতে আবারও রোজগারের সন্ধানে নামতে হয় তাকে। তবে মেরি অ্যানের মুখের দিকে চেয়ে কেউ তাঁকে কাজ দিত না। উল্টে অপমান করে তাড়িয়ে দেয় অথবা ঠাট্টাতামাসা করেন। দিন কাটানোই কঠিন হয়ে ওঠে মেরি অ্যানের।

তার স্বামীর মৃত্যুর পর, ঘরে কোন উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি না থাকায়, ঋণ টাকা পরিশোধ করতে এবং তার চার সন্তানের আর্থিক চাহিদার মেটাতে , তিনি অপমানজনক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি “বিশ্বের সবচেয়ে কুশ্রী মহিলা” এর আপত্তিকর খেতাব জিতেছিলেন।

এর পরে তাকে একটি সার্কাস পার্টির সাথে যোগ দেন। যেখানে তিনি বিভিন্ন শহরে শহরে ভ্রমণ করতেন এবং লোকেরা তাকে দেখে হাসতে এবং অপমান করতো। মানুষ সন্তানদের জন্য কিনা করতে পারে ভাবুন তো।

মেরি অ্যানকে নিয়ে এভবে ঠাট্টাতামাশার বিরুদ্ধে এক সময় সোচ্চার  হয়ে উঠেছিলেন চিকিৎসকেরা। তিনি যে ‘অ্যাক্রোমেগ্যালি’-র সমস্যায় ভুগছেন, তা কোনও ভাবে সবার সামনে চলে আসে। ১৯২৭ সালে সে সময়কার একজন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ হার্ভি কাসিং চিঠি লিখে এসবের প্রতিবাদ জানান। মেরি অ্যানের চেহারাকে যে ভাবে হাসির খোরাক করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন হার্ভি। তবে এতসন প্রতিবাদ সত্ত্বেও সার্কাসে মেরি অ্যানের শো বন্ধ হয়ে যায়নি।

তিনি তার সন্তানদের লালন-পালন করতে এবং তাদের একটি সুন্দর জীবন উপহার দেওয়ার জন্য অন্যদের উপহাস, অপমান প্রতিদিন সহ্য করতেন। তিনি ১৯৩৩ সালে মারা যান।

সালে ৫৯ বছর বয়সে মারা যান তিনি

আজ পর্যন্ত, সমাজ মানুষকে তাদের শারীরিক গঠনের উপর বিচার করে। আমাদের চর্ম চক্ষু যদি দেহের অসুন্দর চেহারার পরিবর্তে তার আত্মার সৌন্দর্য দেখতে পেত, তবে মেরি অ্যান বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা হতে পারতেন। আমার চোখে তিনি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মানুষ এবং মা। মায়েরা কখনও অসুন্দর হয়না।

আরো পড়ুন- মাদার বখসের জীবনী