কারণ, এতে ওই কর্মকর্তার কোনো বঞ্চনা হয় না। এ ব্যবস্থার উৎস ব্রিটিশ প্রশাসন। ঔপনিবেশিক শাসনামলে নেটিভ এবং শ্বেতাঙ্গ অফিসারদের আলাদাভাবে শাস্তি দেওয়া হতো। এই শাসনপদ্ধতিকে পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন ‘ঔপনিবেশিক পার্থক্যের শাসন’ (দ্য রুল অব কলোনিয়াল ডিফারেন্স)। নেটিভ ভারতীয়রা স্বভাবগতভাবে সাহেবদের চেয়ে বেশি দুর্নীতিপরায়ণ, এ বিশ্বাস থেকেই বদলিকে একটি প্রথা হিসেবে গড়ে তোলা হয়, যাতে কোনো ভারতীয় এক স্থানে বেশি দিন থেকে জনমত নিজের অনুকূলে না আনতে পারেন। এই আমলাতান্ত্রিক প্রথা পরে আমাদের দেশে সুদৃঢ়ভাবে গেড়ে বসে।
দুই. আইনের পজিটিভিস্ট ব্যাখ্যা যেখানে আইনের ক্লাসে প্রথমেই শেখানো হয় আইন হলো সার্বভৌমের আদেশ। এর ফলে আইনের ব্যাখ্যা আর প্রয়োগ আমাদের বিচার ও প্রশাসনের কাছে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, যেখানে সামাজিক বাস্তবতার বিবেচনা আসে তাত্ত্বিক নীরস ব্যাখ্যার পরে।
দুঃখের কথা হলো, ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হলেও আমাদের দেশের আইনি এবং প্রশাসনিক কাঠামো এখনো ব্রিটিশ আমলের আইন দ্বারা পরিচালিত। ফলে আমাদের প্রশাসনিক অনেক কাজকর্মে ঔপনিবেশিক হাবভাব চলে আসে, যেমন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের স্যার সম্বোধনের ওপর জোর দেওয়া, নিজেদের অন্যায় বা অসদাচরণ অস্বীকার করে জনগণকে অপমান করা বা তাদের ওপর দায় চাপানো ইত্যাদি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, স্যার সম্বোধন বদলালেই কি ঔপনিবেশিক পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বদলে যাবে? না। কিন্তু ভাষার ব্যবহার মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করে।
আজকাল ভাষায় লিঙ্গবৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে যখন নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই পুংলিঙ্গ শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে, অথবা পুংলিঙ্গ শব্দ বাদ দিয়ে পুরুষ বা নারী কোনোটাই নয়—এমন কোনো শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে, দুই রকম ফলাফল হচ্ছে—১. অবচেতনভাবে নারীবাচক শব্দকে হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে; ২. পুংলিঙ্গকে মানদণ্ড হিসেবে ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ঘুরেফিরে নারীবাচক অবস্থানকে পুরুষের চেয়ে হীন প্রমাণ করা হচ্ছে।
ইংরেজি স্পাউসের আদলে কোনো উভয়লিঙ্গ শব্দ বাংলায় নেই। বাংলা স্বামী শব্দটি কেবল একজন নারীর বিবাহিত পুরুষ সঙ্গী বোঝায় না। স্বামী শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ কর্তা বা মালিক অর্থাৎ একটি অধিকারগত ক্ষমতা জড়িত। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ‘হাজবেন্ডকে’ নারীর কর্তা হিসেবেই দেখা হয়। কাজেই যত দিন পর্যন্ত স্পাউসের মতো কোনো লিঙ্গবৈষম্যহীন শব্দ বাংলায় না আসবে, তত দিন আমরা রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব থেকে বঞ্চিত হব। স্যার/ম্যাডাম এসব কলোনিয়াল শব্দের পরিবর্তে আমাদের নিজস্ব শব্দ খুঁজে বের করতে হবে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে শব্দের ব্যবহার জরুরিভাবে সম্পৃক্ত। স্যার বললে কেবল নারী না, লিঙ্গবৈচিত্র্যময় মানুষেরাও বৈষম্যগ্রস্ত হন। লিঙ্গ বৈচিত্রময় মানুষদের নানা পরিচয় আছে, যেমন লিঙ্গ রূপান্তরকামী মানুষ, ট্রান্স নারী, ট্রান্স পুরুষ, জেন্ডার ফ্লুয়িড মানুষ, ননবাইনারি মানুষ, হিজড়া এবং আরও অনেকে। সবাইকে গণহারে স্যার বললে তাদের আত্মপরিচয়ের অধিকারকে অপমান করা হয়।
অনেকে প্রশ্ন তুলবেন, নিজ কর্মগুণে কেন নারী নিজের নারীত্বকে অহংকারের বিষয় করে তোলে না? নারী একা কেন, যেকোনো লিঙ্গপরিচয়ের মানুষেরই নিজ নিজ কর্মবলে শক্ত অবস্থানে যাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু সমাজ যখন একজন পুরুষ অধ্যাপক আর নারী অধ্যাপকের কাজকে একই মানদণ্ডে মানতে চায় না, সমাজ যখন একজন হিজড়া দোকানদারের কাছ থেকে জিনিস কিনতে চায় না, তখন আমাদের বাধ্য হয়ে এসব শব্দের রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে কথা বলতে হয়।
Discussion about this post